—————————-বৃদ্ধাশ্রম———————
প্রায় বেশিরভাগ পরিবারে শেষ বয়সে অবহেলার স্বীকার হন মা- বাবা। কিন্তু কেন এই অবহেলা? কেন তাদের হেয় করা? অতি স্নেহে আদরে যাদেরকে বড় করে তুলেন তাঁরাই কেন তাদের দুঃসময়ে বৃদ্ধাশ্রমের ঠিকানা দেখান। নিজে কষ্ট করে যে বাবা তাঁর ছেলের খরচ চালিয়ে যান দিনের পর দিন, সেটাই কি ছিল তার অপরাধ? বছরের পর যে বাবা একটা পুরোনো জুতো পড়ে অফিস করে ছেলের পরিক্ষার খরচ চালিয়ে যেতেন, নিজে না খেয়ে ছেলেকে টাকা পাঠাতেন, যাতে সে অন্যান্য বন্ধুদের কাছে ছোট না হয়, সেটা হয়তো ছিল তাঁর অপরাধ।
জন্মদাত্রী মা যে কিনা শিশুকাল থেকে বড় হওয়া পর্যন্ত ছায়ার মতো লেগে থাকতো সন্তানের সেবায় সেই মা ই বা কী এমন ভুল করেছিল? যার প্রতিদানে সেই মায়ের স্থান হয় বৃদ্ধাশ্রমে। একজন মা কিনা করে তাঁর সন্তানের জন্য, নিজে না খেয়ে অন্ন তুলে দেন সন্তানের মুখে সন্তানের মুখে হাসি ফোটাতে, একটা সন্তানকে বড় করে তুলতে কত কষ্ট ই না করতে হয় মাকে। সেটা শুধুমাত্র একজন মা ই অনুভব করতে পারেন, তবুও সেই মা একটুও ক্লান্ত হন না, হাসিমুখে সন্তানের সেবা করে যান দিনের পর দিন। কোনো দিন দেখা যায় শেষ রাতে কান্না করে শিশু সন্তানটি, সাথে সাথে মায়ের ঘুম ভেঙ্গে যায়, সন্তান কে জড়িয়ে আদর করেন, আবার তাকে ঘুম পাড়িয়ে দেন। শুধু তাই আরো কত কষ্ট করতে হয় মাকে সেটা হয়তো লিখে শেষ করা যাবে না কখনো।
জ্যোতিষ এর নিরীখে দেখতে গেলে
১, চতুর্থ ভাব যদি পীড়িত হয়।
২, চতুর্থ পতি যদি ৬,৮,১২ ভাবে অবস্থান করে।
৩, চন্দ্র যদি ভীষণ ভাবে পীড়িত হয়।
তাহলে আপনাকে শেষ জীবনে এমন দিন দেখতে হতেও পারে, যদি সেই সময় আপনার ১২ ভাবের দশা বা চতুর্থ ভাব যুক্ত কোনো দশা অতিবাহিত হয় তাহলে আপনার সাথে এমন ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা অনেকটাই বেড়ে যায়।
লেখাটা লিখতে গিয়ে মনটা উদাস হয়ে গেল, একটা কবিতা মনে পড়ে গেল আমার, শ্রীজাত বেশ লিখেছে, আপনাদের কেও সোনাই।
জানো মা, আমি ভালো নেই।
ভাবছিলাম- তোমাকে বলবো বলবো ;
কিন্তু কেমন যেন লজ্জা হয়।
আসলে কখনো তো, জিজ্ঞেস করিনি তোমাকে–
“মা, কেমন আছো তুমি”?
তোমার ভালোবাসা পেতে পেতে
পাওয়ার অভ্যাসটা– কেমন অধিকার হয়ে গেছে।
একরকম ধরেই নিয়েছি–
ভালোবাসা শুধু, তোমারই ভীষণ কর্তব্য
আমার একদম নয়।
মা, ভালো আছো তুমি ?
কেমন করে, ভালো থাকবে তুমি ?
আমি ভরা সংসার, আর ভরা পকেট নিয়ে
ভালো থাকতে পারিনা ;
আর তুমি– শূন্য ঘরে, শূন্য হৃদয়ে
কর্পদক শূন্য হয়ে–
কেমন করে ভালো থাকবে ?
তোমার গেঁটে বাতটা কেমন আছে, মা ?
সরি। তুমি বলেছিলে কয়েকবার –
যে- বাতটা তোমাকে বড় ভোগাচ্ছে।
আমি তা কেবলই ভুলে যাই।
কেন জানি, তবুও মনে হয়-
তুমি আমাকে, আগের মতোই ভালোবাসো।
এখনো তুমি, আমার যন্ত্রণায়-
ঠিক আগের মতোই হাত বুলিয়ে দেবে।
আচ্ছা মা
তোমার ভালোবাসার ক্লান্তি নেই কেন?
আমার ভালোবাসার ক্লান্তি আছে ;
মালবিকার ভালোবাসার ক্লান্তি আছে ;
শুধু তোমার-টার ক্লান্তি নেই।
কেন মা ?
খুব তাড়াতাড়িই তোমার কাছে আসবো।
তুমি একটু, আমার বুকে হাত বুলিয়ে দেবে।
আমি ছটফট করছি ;
যন্ত্রণায় ছটফট করছি, মা।
এসেছিলাম, সাত সাগর পেরিয়ে
আকাশ ধরতে ;
আকাশ-টা, আকাশেই রয়ে গেলো ;
শুধু মাটি-টা, পায়ের থেকে সরে গেলো
মা-টা, বুকের থেকে সরে গেলো
মানুষজন, হৃদয় থেকে সরে গেলো।
জনারণ্য নিউয়র্কের রাস্তায়-
আজকাল– তোমার আঙুল খুঁজে বেড়াই ;
ভয় হয় ; বুঝি কোন
অজানা জঙ্গলে হারিয়ে যাচ্ছি।
ওরা সবাই কেমন অপরিচিত-
কথা হয় ; কিন্তু হৃদয়ের সংযোগ হয় না।
স্পর্শ হয় ; কিন্তু অনুভূতি হয় না।
জানো মা
অভ্যাসের একটা ক্ষয়িষ্ণু ক্ষমতা আছে ;
অমৃতও ধীরে ধীরে, কেমন যেন নোনতা হয়ে যায় !
তোমার ভালোবাসাও কেমন যেন, প্রতিদিনকার অভ্যাস হয়ে গেছিলো।
প্রতিদিন মধু খেলে, মধুকে আর মধু মনে হয় না।
আজ- বহুদূরে, সাত সাগরের পাড়ে
তোমার স্নেহ-চ্যুত আমি ;
তোমার একটু ভালোবাসার জন্য, আকুল হয়ে আছি।
হয়তো ক্ষয়িষ্ণুতার কারণে ;
মালবিকার মধুতেও, আজকাল তৃপ্তি আসে না।
আমাদের সম্পর্কটাও কেমন যেন
নিছকই একটা অভ্যাস হয়ে গেছে।
নদী আছে, স্রোত নেই ;
বায়ু আছে, বেগ নেই ;
জীবন আছে, প্রবাহ নেই।
সবই যেন কেমন মৃয়মান !
আচ্ছা মা, বলো তো-
জীবনে প্রবাহ কিভাবে ধরে রাখা যায় ?
মাঝে মাঝে ভাবি –
আমাদের অভ্যাসে আসক্তিই এর কারণ।
চেনা ঘর, চেনা জগতের বাইরে যেতে-
আমাদের বড় ভয়।
মানুষ জানে- অভ্যাসে জীবনের মৃত্যু ;
তবুও সে, অভ্যাস ত্যাগ করতে পারে না।
–
তাইতো জীবন প্রবাহ হারায়।
আর তখনই জমতে থাকে– বিষাদ, আর যন্ত্রণার শ্যাওলা।
মা, আমার তো কিছুরই অভাব নেই
তবু বুকটা কেন এতো, শূন্য বলো তো ?
মালবিকা বুকে হাত বুলিয়ে দেয় ;
কিন্তু যন্ত্রণা-টা আবার ফিরে ফিরে আসে।
আমি ভালো নেই, মা।
ক্রমশ– বিষাদের ছায়ায় আবিষ্ট হয়ে যাচ্ছি।
কেমন যেন- নিজেরই পাতা যন্ত্রণা-জালে
দিন দিন জড়িয়ে যাচ্ছি।
বাড়ি-গাড়ি, ধন-ঐশ্বর্য্যকে
ভেবেছিলাম সুখের বাহক।
আজ দেখছি-
এগুলো সবই কেমন, আমার যন্ত্রণার ধারক।
আজ আমার-
সুন্দর দাঁত আছে, হাসি নেই।
চকচকে কলেবর আছে, হৃদয় নেই।
বড় ঘর আছে, সুখ নেই।
এমন কেন হলো, মা ?
এখন দেখছি-
পরিশ্রম করলেই, সুখ আসে না।
বড় হলেই, মহান হয় না।
আমি কি তবে, জীবনের গন্তব্য-টাই হারিয়ে ফেলেছি ?
এখন- তোমার কথা মনে পরে, মা।
তুমি বলতে –
খোকা, জীবনে খুব হাসবি ;
তবেই সুখী হবি।
আমি, আজকাল আর হাসি না।
পল্টু বলে – “পাপ্পা, তোমার মুখটা
সবসময় কেমন- পচা-পচা।
তুমি হাসো না কেন, পাপ্পা ?”
আমি হাসতে ভুলে গেছি, মা-
আমি ভালো নেই।
সম্রাট বোস
7890023700